সেদিন সন্ধ্যে, যে সময়ে বাবা অফিস থেকে ফেরে, ঠিক সেই সময়ে রঘুর গাড়ি এসে দাড়ায়ে আমাদের বাংলোর কাছে|
বাবাকে দেখতে না পেয়ে রঘুকে জিজ্ঞেস করে মা বাবা কোথায়, তার উত্তরে রঘু জানায় বাবাকে রজত সেথের কিছু গুন্ডা হামলা করে এবং বাবা হাসপাতালে|
আমদেরকে তৎখনাত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়ে| সেখানে শেখর কাকু ছিলো, মাকে দেখে বলল – “চিন্তা করো না কাকলি… জয়ন্ত ঠিক আছে…. জ্ঞান আসেনি কিন্তু স্বাভাবিক|”
বাবার জ্ঞান হারিয়েছে শুনে মায়ের পায়ের থেকে মেঝে সরে গেলো, প্রায়ে পরে যাচ্ছিলো যদি না রঘু এসে ধরতো| শেখর কাকু – “কাকলি তুমি নিজেকে সামলাও”
মা রঘুর হাত দুটো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে – “আমায়ে নিয়ে যান.. ওকে দেখতে চাই”
শেখর কাকু – “বাবাই এখানে থাক.. তুমি আমার সাথে চলো”|
আমাকে রেখে মা শেখর কাকুর সাথে চলে গেলো হাসপাতালের উপরের রুমে এবং তার মাঝে হটাত দেখলাম শিখা কাকিমা চলে এসছে সুমন্তের সাথে| আমাকে দেখে শিখা কাকিমা জিজ্ঞেস করলো – “কিরে তোর মা কোথায়?”
আমি জানালাম শেখর কাকু মাকে হাসপাতালের উপরের ঘরে নিয়ে গেছে| শিখা কাকিমা বলল – “রাজা.. তুই বাবাইকে কে নিয়ে বাড়ি যা… রঘু ওদের নিয়ে যাও”
আমি – “কাকিমা.. আমি মাকে ছেড়ে যাবো না|”
শিখা কাকিমা – “তর্ক করিস না বাবাই…কাকিমার কথা শোন| হাসপাতালে বেশিক্ষণ বাচ্চাদের থাকা উচিত নয়|”
আমি চুপ করে গেলাম এবং রঘু আর সুমন্তের সাথে সুমন্তের বাড়ি চলে গেলাম| সুমন্ত গাড়িতে যাওয়ার সময়ে চুপচাপ ছিলো কিন্তু বাড়িতে পৌছে নিজেকে আটকাতে পারলো না আর জিজ্ঞেস করলো – “তুই আমাকে এরকম ভাবে এরাচ্চিলিস কেনো অভি…আমি তো তোকে বন্ধু হিসাবে সব বলেছিলাম|”
আমি শেষ পর্যন্ত মুখ খুললাম – “আমি কিছু বুঝতে পারছি না কি হলো সেদিন… বাবা ওরকম রেগে গেলো কেনো… আর সেদিন তুই বলছিলিস কাকিমার সাথে অনেক নোংরা জিনিস করেছে এই গ্রামের লোকেরা… কি হয়েছে সুমন্ত?… তুই আমায়ে খুলে বলছিলিস না কেনো?”
সুমন্ত – “তুই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য বুঝিস?”
আমি – “কি পার্থক্য?.. ছেলেদের চুল ছোট হয়ে আর মেয়েদের বড়”
সুমন্ত মুচকি হেসে বলল – “আর কোনদিনও ভেবেছিস.. মেয়েদের বুকের ব্যাপারে|”
আমি – “হ্যাঁ.. মেয়েদের দুধ হয়ে.. যখন মেয়েরা বড় হয়ে যায়”
সুমন্ত – “আরেকটা জিনিস আছে… মেয়েদের নুনু হয় না…”
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম| সুমন্ত – “হ্যাঁ …আমি সব সময়ের সাথে জেনেছি… তুই জানিস ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়ে কেনো?”
আমি – “আমি ভাবিনি….”
সুমন্ত – “তুই কি কাকু কাকিমাকে জিজ্ঞেস করেছিস তুই পৃথিবীতে এসেছিস কি ভাবে|”
আমি – “হ্যাঁ”
সুমন্ত – “কি বলেছে কাকু কাকিমা?”
আমি – “ভগবান পাঠিয়েছে আমাকে পৃথিবীতে”
সুমন্ত – “সব মিথ্যে কথা অভি… আমি সব জেনেছি এই গ্রামে আসার পরে| সেদিন যা আমার বাবা মা কাকু কাকিমাকে বুঝিয়েছিলো সব মিথ্যে| আমার মায়ের সাথে দীপক কাকুর বিয়ে হয়েছিলো এবং দীপক কাকু প্রথম এই সব শুরু করে আর তারপর আস্তে আস্তে আমার মাকে তুলে দেয় অন্য গ্রামের লোকেদের হাতে| আমার মায়ের তিন বার বিয়ে হয়েছে এই গ্রামে, প্রথমবার দীপক কাকু তারপর রামচন্দ্র আর শেষে রজত সেথ| মায়ের দুবার পেট ফুলেছিলো, প্রত্যেক বার বাচ্চা হওয়ার পর মাকে নতুন করে বিয়ে দেওয়া হয়ে| ..তুই জানিস না আমার এক ভাই আর বোন আছে| আমার বাবা মায়ের বিয়েতে আমি জন্মেছিলাম আর মায়ের বাকি বিয়েতে আমার ভাই আর বোন জন্মেছে| এটা হচ্ছে এই গ্রামের প্রথা একবার যদি কোনো এই গ্রামের পুরুষ মানুষের সাথে যদি কোনো মহিলার বিয়ে হয়ে যায়ে সে পুরোপুরি এই গ্রামের বন্দিনী হয়ে যায়ে কিন্তু প্রথম বিয়েটা সেচ্চায়ে হতে হবে| এই প্রথা থেকে বেড়ানোর শুধু একটা উপায়ে যদি সেই মহিলাকে এই গ্রামের কোনো পুরুষ যে সেই মহিলার বর্তমান স্বামী তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে এবং তাকে পুরো পঞ্চায়েতের সামনে সেটা বলতে হবে এবং পঞ্চায়াতকে রাজি হতে হবে এই ব্যাপারে| কাকিমাকে দেখার পর থেকে রজত সেথ আমার মাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে এবং পঞ্চায়াতের লোকেরা রাজি যদি কাকিমা এই গ্রামে বন্দিনী স্ত্রী কর্তব্য পালন করে|”
আমি – “আমি কিছু মাথা মুন্ডু বুঝছি না সুমন্ত”
সুমন্ত – “সময়ে হলে সব বুঝতে পারবি”
আমি – “তুই কি বলতে চায়চিস আমার মায়ের কোনো বড় বিপদ”
সুমন্ত – “জানিনা রে| কিন্তু আমরা সবাই এই গ্রাম থেকে মুক্তি পেতে চাই|”
আমি ঠিক মতো বুঝতে পারছিলাম না সুমন্ত কি বলছিলো, শুধু বুঝতে পারছিলাম যে সুমন্ত অনেক কিছু জানে যা আমার ভালো ভাবে জানা নেই| রাতে মাকে নিয়ে শেখর কাকু আর শিখা কাকিমা ফিরলো| মাকে প্রচন্ড ক্লান্ত দেখ্চ্ছিলো, চোখ গুলো ফোলা ফোলা লাগছিলো, মুখে কান্নার ছাপ ছিলো| এসে আমাদেরকে শিখা কাকিমা খেতে দিয়ে দিলো আর আমাকে বলল সুমন্তের সাথে আজ রাতে শুতে|
আমরা ঘরে চলে যাওয়ার পর সুমন্ত আমাকে বলল – “আবির জেগে থাকিস…..আমরা চলে গেলে বাবা মা এই সব বিষয়ে কথা বলবে কাকিমার সাথে|”
ঘরের আলো বন্ধ করে দেওয়ার পর আমরা কিছুক্ষণ চুপ চাপ শুয়ে ছিলাম| সুমন্ত বলল – “চল আবির এবার ওঠ”|
আমরা চুপ চাপ ঘর থেকে বাইরে বেড়ালাম, দেখলাম সেই মাঝের ঘরে মা , শেখর কাকু , শিখা কাকিমা আর রঘু বসে আছে| শেখর কাকু – “দেখ রঘু …. তোর পায়সার আরো দরকার থাকলে বল আর আপত্তি থাকলে জানা|”
রঘু – “আপনারা যা দিচ্ছেন তাতেই আমি খুশি… কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে যদি এই ব্যাপারে গ্রামের লোকেরা জেনে যায়ে.. আপনি এই এলাকার লোকদের জানেন না…. রজত সেথ কথায়ে সবাই ওঠে বসে|”
শেখর – “দীপক তোকে সব বলেছে কিভাবে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলো এতোদিন…. কিন্তু তোর তো এতদিন লাগবে না…. যখন জয়ন্ত দা ঠিক হয়ে যাবে বৌদিকে নিয়ে চলে যাবে গ্রাম থেকে শিগ্রয়ই|”
মা চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনছিলো|
রঘু – “কিন্তু জয়ন্ত বাবু যদি রেগে যায়ে….”
শেখর কাকু – “রাগবে কেনো… তুই যা করছিস.. তুই তো ভালোর জন্য করছিস…. তুই তো জানিস কি ঘটেছে আজ…. রজত সেথের লোকেরা কেনো হামলা করেছে জয়ন্ত দার উপর…. শুধু গ্রামের লোকের বউ হয়ে থাকলে বৌদি শুধু নিরাপদ থাকবে”
রঘু – “ঠিক আছে ডাক্তার বাবু…”
রঘু মায়ের দিকে তাকালো|
শিখা কাকিমা – “কাকলি…. রঘুকে মানানো হয়ে গেছে… এবার সব তোর উপর.. যা করবি তাড়াতাড়ি কর| এরপর যদি খারাপ কিছু হয়ে , আমাদের কাছে কেঁদে লাভ হবে না|”
মা – “আমাকে একটু ভাবতে দাও…”
শেখর কাকু – “কাল সকালে চলে আসিস…. কাকলি এই সব জিনিস বেশি দেরি করে লাভ নেই…”
রঘু – “ঠিক আছে ডাক্তার বাবু.. আমি তাহলে এখন আসি| সকালে চলে আসবো|”
রঘু চলে যাওয়ার পর, মা বলল – “শিখাদি তোমার সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলতে চাই ”
শিখা কাকিমা শেখর কাকুর দিকে তাকিয়ে বলল – “তুমি রাতের খাওয়ার গুলো একটু গরম করে দাও…অনেক খন হয়ে গেছে…নিশ্চয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে …..আমি কাকলির সাথে কথা বলি”
শেখর কাকু – “হা…তোমরা কথা বোলো| আমি খাওয়ার গুলো গরম করছি|”
শেখর কাকু রান্না ঘরে চলে গেলে, মা শিখা কাকিমা বলে বসলো – “এগুলো একদম ঠিক হচ্ছে না….আমি বিবাহিত…কি করে আমি রঘুকে বিয়ে করতে পারি…আমার খুব ভয় করছে|”
শিখা কাকিমা – “একদম বোকার মতো কথা বলছিস..তুই তো বিয়ে করে রঘুর সাথে সংসার পাতছিস না| যা করছিস তুই তোর পরিবারের জন্য করছিস, দেখলি তো কি ঘটলো আজ…সেদিন একই জিনিস ঘটেছিলো আমাদের সাথে….দীপক না থাকলে আজ আরো অনেক বাজে জিনিস ঘট তো|…আর জয়ন্ত হাতে সময়ে পাবে সব কিছু গুটিয়ে চলে যেতে|”
মা – “তাহলে তোমরা এতদিন এই গ্রামে রয়েছো কেনো ?”
শিখা কাকিমা ততলে তত্লে বলতে লাগলো – “না ওরকম ব্যাপার নয়ে আমরা চাইলে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে পারতাম….”
মা একটু অন্যরকম চোখে শিখা কাকিমার দিকে তাকাতে – “তোর কি বিশ্বাস হয়ে না… আমাদের কোথায়ে…. সেদিন তোদেরকে আমরা জানিয়েছিলাম আর আজ তোকে শুধু বোঝাচ্ছি… তোদের ভালো চাই আমরা|” আর তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল – “শোন্… আমার বরটাকে একটু সাহায্য করি.. খাওয়ার গুলো গরম করার| এই সব জিনিস করার অভ্যাস নেই তো|”
মা বলে উঠলো – “আমার কোনোরকম সাহায্য লাগবে শিখা দি?”
শিখা কাকিমা – “না না..তুই এখানে বোস| আমি আসছি|”
কিছুক্ষণের মধ্যে রান্না ঘর থেকে রাতের খাওয়ার গুলো নিয়ে এলো শিখা কাকিমা আর শেখর কাকু| সবাই খেতে বসলো, সবাই খাওয়া শুরু করে দিলো কিন্তু মা চুপচাপ বসে ছিলো| শিখা কাকিমা – “কি রে কাকলি তুই তো কিছুই খাচ্ছিস না?”
মা – “আমার মাথা কাজ করছে না…বুঝতে পারছি না কি করতে চলছি আমি….”
শিখা কাকিমা – “একটু কিছু তো খা কাকলি”
মা – “শিখা দি …আমার কিছু খেতে ভালো লাগছে না…আমি কোন ঘরে শোবো বলে দাও…আমি চলে যাচ্ছি|”
শেখর কাকু – “কাকলিকে জোর করো না….ও কোন ঘরে শোবে দেখিয়ে দাও|”
শিখা কাকিমা মাকে নিয়ে গেলো অন্য একটা ঘরে, ফিরে এসে বসে থাকা শেখর কাকুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল – “তোমার কি মনে হয়ে কাকলি রাজি হয়ে যাবে?…. আমরা কি মুক্তি পাবো?”
শেখর কাকু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল| দুজনকে চুপচাপ খেতে দেখে আমরা আমাদের ঘরে ফিরে এলাম| আমি আর সুমন্ত বেশিক্ষণ কথা বললাম না এবং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম|
এই গল্পের পরবর্তী পর্ব
গল্পটি কেমন লাগলো এবং পরবর্তীতে কোন ক্যাটাগরির গল্প চান? কমেন্ট করে জানান। ধন্যবাদ!