এই গল্পের পূর্ববর্তী পর্ব
বাড়ি ফিরতেই অসিতকে ফোন করলাম, ও বলল,
“আমি জানতাম। যত বড় দরের কেউ হোক কিনা, তোমায় ফেরাতে পারবে না। আর এত সহজে হল সেটা দেখে মনে হচ্ছে, দেখো গিয়ে সুবীর হয়ত বানিয়ে বলেছিল, বাঙালিরা তো অপরের ভালো করতে চায়না। তবে যাই হোক, ওর জন্য ভালো স্যার পেলে, ওকে ভালোমন্দ খাইয়ে দিও”।
পরদিন ক্লাস শেষে সুবীরের সাথে পড়তে গেলাম, আমি ছাড়া বাকি পাঁচজন ছেলে, সবাই চাকরি করছে। সবার সাথেই আলাপ হল। তুষার বাবু সম্পর্কে জানলাম উনি একজন মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন একটি বিরাট কোম্পানিতে কিন্তু কোন বিশেষ কারণ বশত চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতা করছেন, একা মানুষ বিয়ে করেননি। ওনার শেখানোর পদ্ধতি এত ভালো যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না, মনে বিশ্বাস জন্মাতে লাগল যে সত্যি শিখতে পারব।
কয়েকদিন ক্লাস করার পর উনি পরীক্ষা নিলেন, আমি সবচেয়ে কম নম্বর পেলাম, তাতে খুব শান্ত, ধীর আর ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“প্রথম দিনের সেই শিখতে চাওয়ার উৎসাহটা কি শুধু ভর্তি হওয়ার জন্য ছিল ?”
খুব লজ্জিত হলাম, কষ্ট হল খুব আর সবার সামনে ওভাবে বলার জন্য, ওনার উপর খানিকটা অভিমান হল। কিন্তু ক্লাস শেষে সবাই চলে গেলে আমি যাওয়ার আগে ওনাকে বললাম,
“আমি অনেক পরে ভর্তি হয়েছি, অনেকটাই জানা নেই, তাই সব পারিনি, যেটা পড়েছি সেগুলো তো সব পেরেছি”।
উনি হেসে ফেললেন, অদ্ভুত হাসি ওনার, একবার দেখলে রাগ করা যায় না।
বললেন,
“জোর করে ভর্তি হলে আর এক্সট্রা ক্লাস চাইলে না কেন? দেখতে! সেটাও পেয়ে যেতে”।
কথাটায় যেন কি একটা ছিল! ঠিক বুঝলাম না কিন্তু খুব ভালো লাগল । মনে হল উনি যেন বললেন, আমার জন্য উনি সব কিছু করতে পারেন।
ফিরে অসিতকে ফোনে সব জানালাম, শুনে খুব এক্সাইটেড হয়ে গেল, বলল,
“তুষার বোস তোমার প্রেমে পড়েছে, চান্স ছেড়োনা , এই সুযোগ! প্রেম করে নাও। আমি ছাড়াও যে অনেকেই তোমায় কামনা করে সেটা প্রমাণ পাবে, আর ভদ্রলোক ভালো, তোমার ক্ষতি করবেনা , তাই তুমি সেফ, আর তুমিও ওনাকে বেশ পছন্দই করো তাই বাঁধাও নেই ”।
রাগ হল অসিতের কথায়, কিন্তু পরে ভাবলাম আমি তো সত্যি ওনাকে পছন্দ করি; আর উনিও করেন সেটা বুঝি। কিন্তু অনেক সময়ই আমরা অনেক কিছু বুঝেও কিছু করতে পারিনা।
ইন্সটিটিউটের তিন দিন ছাড়া বাকি দিন সকালে ফাঁকাই থাকতাম, এক্সট্রা ক্লাসের জন্য উনি সকালে যেতে বললেন। প্রথম দিন গিয়ে দেখলাম আর কেউ নেই, জানলাম সকালে উনি লেখালেখি করেন, পড়ান না। দেখে মনে হল সকালে সবে উঠেছেন কিছু খাওয়া হয়নি, জিজ্ঞাসা করায় সম্মতি জানালেন সাথে এও বললেন আমি যেন এসব না ভাবি। বললাম, আমার ব্যাপারে যখন উনি এত ভাবছেন তখন তো আমার না ভেবে উপায় নেই। উনি আর কিছু বললেন না। ওনার রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম একজন সুগৃহিণীর মতন সুন্দর গোছানো রান্নাঘর। ডিম টোস্ট আর চা বানিয়ে টেবিলে এসে বসলাম। রান্নাঘরের কথায় জানলাম একা থাকার জন্য সব শেখা। সেদিন পড়া শেষে বাড়ি ফিরলাম।
রোজকার ক্লাসের পাশাপাশি এক্সট্রা ক্লাস গুলো করতে থাকলাম । পড়া, গল্প,সব মিলিয়ে একাকীত্ব আমায় কষ্ট দিত না। রাতে অসিতের সাথে ফোনে কথা বলতাম। দিনগুলো ভালোই কাটছিল।
আমার জন্য সবচেয়ে খুশি ছিল অসিত।
তুষারের সাথেও আমি অনেক কথা বলতাম, অসিতের কথা, ও না থাকায় আমার খারাপ লাগা , আমাদের ভালোবাসার কথা; প্রায় সবই বলতাম। উনিও মন দিয়ে শুনতেন, সাহস যোগাতেন। আমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম।
এমনই একদিন জিজ্ঞাসা করলাম উনি কি সত্যি মেয়েদের পড়াতেন না?
তাতে আমায় উনি জানালেন, মেয়েরা বরাবর ওনাকে বেশি পছন্দ করত। সেটা ওনার ইমিডিয়েট বস খুব ভালো চোখে দেখতেন না, সাদা বাংলায় হিংসে। তারপর কোন এক মেয়েকে এনে ওনাকে নানা সমস্যায় ফেলেন, উনি তখন স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।
“তাহলে আমায় কেন পড়াতে রাজী হলেন”?
“তুমি স্পষ্টবাদী, নিজের যা চাই পরিষ্কার বলো, তুমি আর সবার মতন না, আলাদা, তাই”।
“ একবার দেখেই বুঝে গেলেন ?”
উনি চোখে চোখ রেখে বললেন,
“আমিও স্পষ্টবাদী, সত্যি কথা বলতে ভালোবাসি। তোমায় দেখেই আমার খুব ভালো লেগেছিল, মনে হয়েছিল তোমায় আমি অনেকদিন চিনি, অনেক যুগ ও বলা যায়, তাই তোমায় ফেরাইনি, হয়ত আমার কথা গুলো শুনে তোমার ভালো লাগছে না, কিন্তু এটাই সত্যি। আর এখন তো আমি তোমায় ভালোবাসি”।
কথাগুলো শুনে স্থবিরের মতন বসে রইলাম। অসিতের কথা মনে পড়ল। উনিও বিশেষ কথা বাড়ালেন না।
বাড়ি ফিরে একটা অজানা ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল, উনি যে আমাকে মন থেকে ভালোবাসছেন সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
রাতে অসিত ফোন করলে ওর কাছে অকপটে সব বললাম, এটাও গোপন করলাম না যে আমার ও ওনাকে ভালোলাগে। অসিত সব শুনে বলল,
“আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ,বিশ্বাস করি, জীবনে সব কিছু তুমি পাও সেটা চাই, তোমার মন যা চায় তাই করো, আমি তোমার সাথে আছি, সত্যি ভালোবাসা খুব ভাগ্য করলে পাওয়া যায় তাই তাকে খালি হাতে ফিরিও না”।
পরদিন সকালে পড়তে গেলাম, ওনাকে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে দেখলাম। তাই আলাদা কোন অস্বস্তিতে পড়লাম না। অসিতের ভালোবাসা আমার মনে সাহস যোগাতো যাতে আমি আমার ভালোলাগার সব কাজ করতে পারতাম আর তুষার ও ছিল খুব সহজ সরল,ওর সারল্য আমায় ওকে ভালোবাসতে বাধ্য করত।
শনি রবি ছুটি থাকে। সোমবার সকালে গিয়ে দেখি জ্বর হয়েছে শুয়ে আছেন। বললেন ,
“মাথায় খুব ব্যথা আজ পড়াতে পারবো না। তুমি সকলকে একটু মেসেজ দিয়ে দাও”।
মেসেজ করে ওনার মাথার পাশে বসলাম কপালে হাত দিয়ে দেখি হালকা গরম, হাত ছোঁয়াতে আমার দিকে তাকালো, আমার হাতটা ধরে চোখের পাতার উপর রাখল, হাতের তালু দিয়ে হাল্কা চাপ দিলাম, আরামে অস্ফুটে আহঃ করে উঠল। আমি দুটো হাতের তালু দিয়ে দুচোখে চাপ দিলাম, হালকা হাতে কপাল টিপে দিলাম, মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে বিলি কেটে দিলাম। উনি চোখ বুঁজে ছিলেন, দেখে মনে হচ্ছিল আরাম পাচ্ছেন। একটু পরে চোখ খুলে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমার লজ্জা করতে লাগল, উনি সেটা বুঝতে পেরে বললেন,
“এই কারণেই তোমাকে ভালোবাসি। তুমি নিজে থেকেই সেইগুলো করলে যেটা আমার দরকার ছিল”।
আমি বললাম,
“আমার তো মনে হয় আরো অনেক কিছু দরকার আছে !”
কথাটা বলে আমি খাটে উঠে, খাটের মাথার দিকে বসলাম, বালিশ থেকে ওনার মাথাটা তুলে নিজের কোলের উপর রাখলাম, আবার মাথায় , কপালে হাত বোলাতে লাগলাম, তুষার হেসে চোখ বুজে শুলো, আমি ওর ঘুমন্ত মুখখানা দেখছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে ওঠার পর আমি দুজনের জন্য রান্না করলাম, খাওয়ার পর ওর ঘরে গেলাম, ও বিছানায় শুলো, আমি ওর পাশে বসলাম, দুজনে অনেকক্ষণ কথা বললাম, বিকেলে বাড়ি ফিরে এলাম। আজকাল সুবীর আমার সাথে বিশেষ কথা বলতো না। জানি না কেন! অবাক হতাম! অনেকবার জিজ্ঞাসাও করেছি কিন্তু ও সন্তর্পণে এড়িয়ে যেতো।
এই গল্পের পরবর্তী পর্ব
গল্পটি কেমন লাগলো এবং পরবর্তীতে কোন ক্যাটাগরির গল্প চান? কমেন্ট করে জানান। ধন্যবাদ!
1 thought on “অব্যক্ত (দ্বিতীয় পর্ব)”